মলদ্বার নিয়ে কথা বলতে আমরা যেকোন মানুষ খুব অস্বস্তি বোধ করি। তাই মলদ্বার জনিত সমস্যা গুলো আমরা কম বেশি এড়িয়ে চলি । তাই এ সম্পর্কিত রোগ সমূহ ব্যাপারে আমরা খুব একটা অবগত নই। এমনকি মলদ্বারের রোগ সমূহ কি? এদের নাম কি? এবং কি কারণে এ ধরনের রোগ হয়ে থাকে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। প্রতিকার তো দূরের বিষয়। তাই আজ আমরা এমনই এক রোগ সম্বন্ধে জানবো যা মলদ্বারের খুব কমন একটি রোগ, কিন্তু এর সম্বন্ধে মানুষের জানার পরিধি খুব কম। রোগটির নাম এনাল ফিসার। সঠিক সময়ে এ রোগের চিকিৎসা করানোর খুব জরুরী, অন্যথায় খুব বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হলে আমাদের জানতে হবে এনাল ফিসার কি? এর লক্ষণ সমূহ এবং এর প্রতিকার। তো চলুন শুরু করা যাক।
এনাল ফিসারঃ
এনাল ফিসার হচ্ছে মলদারের শেষ অংশে একটি চিরে যাওয়া বা ফেটে যাওয়া ঘা। এটি সাধারণত শক্ত বা মোটা মলের আঘাতে ছিড়ে গিয়ে শুরু হয়। এই রোগ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে যেমন খুবই ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে তেমনি অবহেলা করলে মারাত্মক ভোগান্তিকর হতে পারে।
আমরা মলদারের যত রোগী পাই, তার মধ্যে এনাল ফিসার সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। এনাল ফিসার হলে সাধারণত মলদারে ব্যাথা থাকে, রক্ত যেতে পারে এবং মলদারের ছিদ্র ছোট হয়ে যেতে পারে। এনাল ফিসার এই রোগটি সচরাচর কম বয়সী মেয়েদের হয়ে থাকে, তবে এটি যেকোন বয়সেই হতে পারে। শুরুতে চিকিৎসা করলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এনাল ফিসার চিকিতসাতেই ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিতসা সত্তেও যাদের বারবার এই রোগ দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে অপারেশন লাগে।।
এনাল ফিসারের কারণ সমূহঃ
- শক্ত মলের আঘতে ছিড়ে যাওয়া।
- অতিরিক্ত ডায়রিয়াতেও হতে পারে।
- মলদারের মাংস পেশি বেশি টাইট হয়ে যাওয়া।
- কতিপয় রোগ যেমনঃ আলসারেটিভ,কোলাইটিস,ক্রস ডিজিজ ও ইনফেকশন ইত্যাদির কারণেও এনাল ফিসার হতে পারে।
এনাল ফিসারের লক্ষণঃ
- মলত্যাগের সময় ব্যথা হওয়াঃ
ব্যথা অনেক সময় এতো তীব্র হয় যে, মনে হয় চাকুতে মলদার কেটে যাচ্ছে এবং রোগী মলত্যাগ করতে পর্যন্ত ভয় পায়। এই ব্যথা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে।
- মলত্যাগে রক্ত যাওয়াঃ
মলের গায়ে অথবা টিস্যু পেপারে লাল রক্ত দেখা যায়।
- ঝুলন্ত চামড়ার সৃষ্টি হওয়াঃ
মলদারে একটি অতিরিক্ত ঝুলন্ত চামড়া বা বোট দেখা যেতে পারে।
- চুলকানি হওয়াঃ
অনেক ক্ষেত্রে চুলকানির মত সমস্যা দেখা দেওয়া।
এনাল ফিসার নির্ণয়ঃ
- একজন কলোরেক্টাল সার্জন রোগীকে শারীরিক ভাবে পরিক্ষা করেই এনাল ফিসার নির্ণয় করতে পারেন। কখনো কখনো অন্যান্য আরো কিছু রোগের উপস্হিতি নির্ণয়ের জন্য কলোনোস্কপি করা লাগতে পারে।
এনাল ফিসার চিকিৎসাঃ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এনাল ফিসার অপারেশন ছাড়া শুধুমাত্র চিকিৎসাতেই ভালো হয়। এনাল ফিসার অপারেশন ছাড়া চিকিৎসা এর মধ্যে রয়েছেঃ
১.খাদ্যাভাসঃ
- বেশি করে পানি ও আশযুক্ত খাবার (শাক-সবজি, ইসবগুলের ভূষি ও পাকা বেল)
- মল নরম করার ঔষধ
২. সিজ বাথঃ
- একটি প্লাস্টিকের গামলায় তিন লিটার কুসুম গরম পানিতে তিন চা চামচ ভায়োডিন সলুশন ১০% [অথবা দুই টেবিল চামচ খাবার লবন] মিশিয়ে মলদার ডুবিয়ে বসবেন। ১০ মিনিট করে রোজ ৩ বার। দুই সপ্তাহ অথবা ঘা শুকানো পর্যন্ত।
- মলদারের ঘা শুকানো ও ব্যথা নাশের জন্য মলম।
৩. এনাল ফিসারের লেজার চিকিৎসাঃ
শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে এনাল ফিসার সকল প্রাথমিক ও মেডিকেল চিকিৎসা সত্তেও ভালো হয়না। সেক্ষেত্রে অপারেশনের দরকার হয়। অপারেশনের ভয়ে অনেকে কলোরেক্টাল সার্জন না দেখিয়ে হাতুড়ে দেখিয়ে থাকেন। ফলে রোগ আরো জটিল হয়। প্রচলিত অপারেশনে সামান্য একটু ছিদ্র করতে হয় ও অল্প কিছুটা রক্তপাত হয়। লেজার অপারেশনে কোন কাটাছেড়া লাগেনা, কোন রক্তপাত হয়না ও কোন সেলাই লাগেনা। ফলে রোগী খুব তাড়াতাড়ি কাজে যোগদান করতে পারে।
৪.বটুলিনাম টক্সিনঃ
এই ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেও এনাল ফিসারের চিকিতসা করা যায়।
৫. এনাল ফিসার অপারেশনঃ
যাদের চিকিতসায় এনাল ফিসার ভালো হয় না অথবা বার বার এই সমস্যা দেখা দেয় তাদের অপারেশন লাগে। এই অপারেশনে কোন কাটাছেড়া করা লাগে না। ছোট্ট একটু খানি ছিদ্র করে আধুনিক পদ্ধতিতে এই অপারেশন করা যায়। অপারেশনে কোন ব্যথা হয় না। উপরন্ত আগের সকল ব্যথা অপারশনের সাথে সাথেই লাঘব হয়ে যায় এবং মনে হয় যে ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।
দক্ষ ডক্টরের হাতে এই অপারেশনের ফলাফল খুবই ভালো এবং স্হায়ী। তবে অনভিজ্ঞ ডক্টরের হাতে অপারেশন এর ফলাফল স্বরূপ নানান জটিলতা দেখা দেওয়া অথবা রোগ আবার হবার ভয় থাকে ।
এনাল ফিসার চিকিৎসা না কি করালে জটিলতা হতে পারেঃ
এনাল ফিসার ঠিকমত চিকিতসা না করলে ফিসারের ক্ষত স্থানে ফোড়া ও এনাল ফিস্টুলা হতে পারে।
এনাল ফিসার অপচিকিতসার ফলাফলঃ
অনেকে টাকা খরচের ভয়ে অথবা অপারেশনের ভয়ে কবিরাজ ও হাতুড়ে ডাক্তারের শরনাপণ্ণ হয়। তারপর অপচিকিতসায় সৃষ্ট ক্ষতের যন্ত্রণায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার কলোরেক্টাল সার্জনের শরণাপন্ন হন।
কোন ডাক্তার দেখাবেন?
এনাল ফিসার ও মলদারের সকল রোগের চিকিতসায় সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হচ্ছেন কলোরেক্টাল সার্জন।
কলোরেক্টাল সার্জন কি?
কলোরেক্টাল সার্জন হচ্ছেন পায়ুপথ, মলাশয়, বৃহদান্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্র এর সকল রোগের চিকিতসা ও অপারেশনে বিষেশজ্ঞ। তিনি কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের উপর এমএস ডিগ্রী করেছেন কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন অথবা কর্মরত ছিলেন। একজন কলোরেক্টাল সার্জন এসব রোগ সম্পর্কে দীর্ঘদিন পড়ালেখা ও গবেষণা করেছেন তাই তিনি এসব বিষয়ে ডিটেইল জানেন এবং তাদের ভুল করার সম্ভাবনা কম। একজন কলোরেক্টাল সার্জন যেসব রোগের চিকিৎসা করেনঃ পাইলস, কোলন ক্যান্সার, রেক্টাম/মলাশয় ক্যান্সার, পলিপ, এনাল/মলদারের ক্যান্সার, ফিস্টুলা, ফোঁড়া, এনাল ফিসার, রেক্টাল প্রোলাপ্স (হালিশ), কোষ্ঠকাঠিন্য, মলত্যাগে বাধাগ্রস্ততা, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যাথা, আইবিএস, আলসারিটিভ কোলাইটিস, ক্রনস ডিসিস, পেটের ও মলদারের যক্ষা, বমি, পেট ফাঁপা, পেট ফোলা, বদ হজম, পেটে গ্যাস, মলদারে রক্ত যাওয়া, মলদারে ব্যাথা, পাইলোনিডাল সাইনাস ইত্যাদি। বিনা অপারেশনে পাইলসের চিকিৎসা, লেজার চিকিৎসা, কলোনস্কপি, রাবার ব্যান্ড/রিং লাইগেশন, ইঞ্জেকশন স্কেরোথেরাপি, লঙ্গো, STARR, ফিস্টুলা সার্জারী, ল্যাপারোস্কপিক রেক্টোপেক্সি, মলদার রেখেই কোলন ও রেক্টাম ক্যান্সার অপারেশন ইত্যাদি সেবা।
শেষ কথা
পরিশেষে বলা যায় যে, সাধারণত পাইলস বা অর্শ্ব রোগের জন্যে আপনাকে যে কোন ক্ষেত্রেই বেছে নিতে হবে একটি সহজতর জীবনব্যবস্থা। কেননা পাইলসের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আর একে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে একটি সুস্থ খাদ্য বৃত্তান্তের মধ্যে চলে আসতে হবে। পাইলসের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে তাই আজ থেকেই শুরু করে দিন আপনার যাত্রা। এগিয়ে চলুন একটি সুস্থ্য সবল খাদ্যভাসের দিকে। হয়তো প্রথম দিকে একটু মানিয়ে চলতে সমস্যা হবে তবে এক পর্যায়ে আপনি ঠিকই মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারবেন।
অন্য কথায়, পাইলস এর জন্যে আপনি চাইলে একজন ভালো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে ডাক্তার তারিক আক্তার খানের পরামর্শ নিতে পারেন। তিনি পাইলস বিষয়ের একজন অভিজ্ঞ সার্জেন। এর পাশাপাশি তার রয়েছে এই সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ডিগ্রী যেমন এমবিবিএস, এফসিপিএস, এম.এস ইন কোলোরেক্টারাল সার্জারি। পাইলস বিষয়ের যে কোন গুরুতর সমস্যায় আপনি উনার ওয়েবসাইট এড্রেসের মাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যমে যে কোন ব্যাপারে সাহায্য নিতে পারবেন।