বর্তমানে পাইলস খুব পরিচিত একটি রোগের নাম। বয়সে ছোট হোক বা বড় পালস জনিত সমস্যা যে কোন মানুষের হতে পারে। সঠিক সময়ে এটি চিকিৎসা না করলে করলে পরবর্তীতে এটি ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে। তাই এ সমস্যার শুরুতেই তার প্রতিরোধ ও প্রতিকার অথবা রোগ নিরাময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আর সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হলে আপনাদের জানতে হবে পাইলস কি? পাইলস এর লক্ষণ ও তার প্রতিকার গুলো কি? আশা করি এ প্রবন্ধের মাধ্যমে আপনারা পাইলস কি এবং পাইলসের লক্ষণ সমূহের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাবেন। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
পাইলস কি?
পাইলস সাধারণ জনগন মলদারের যে কোন সমস্যাকেই বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু ডাক্তারী ভাষায় পাইলস বলতে হেমোরয়েড নামের একটি নিদিষ্ট রোগকেই বুঝানো হয়। পাইলস (হেমোরয়েড) রোগে মলদারের ভিতর থেকে রক্তনালীর একটি পিন্ড ফুলে যায় ও কখনো কখনো বাইরে বের হয়ে আসে। পাইলস রোগে সাধারণত মলদারে কোন ব্যাথা অনুভূত হয় না। তবে জটিলতা দেখা দিলে ব্যথা অনুভূতি হতে পারে। গ্রাম বাংলায় এই রোগ অর্শ নামে বহুল পরিচিত।
মলদারে পাইলস ছাড়াও এনাল ফিসার, ফোড়া ও ফিসটুলা ,পলিপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ হয়ে
মলদারের রোগ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে যেমন খুবই ভালো ফলাফল তেমনি অবহেলা করলে মারাত্মক ভোগান্তিকর হতে পারে।
পাইলসের প্রকারভেদঃ
পাইলস বা হেমোরয়েড দুই ধরনের হয়ঃ
১. ভিতরের পাইলসঃ রক্তনালীর পিন্ড কতখানি বের হয়ে আসে তার উপর ভিত্তি করে ভিতরের পাইলসকে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ডিগ্রীতে ভাগ করা হয়।
২. বাহিরের পাইলসঃ এটি মলদারের বাইরের চামড়া দারা আবৃত। এটির মধ্যে রক্ত জমাট বাধলে এটি ফুলে যায়।
পাইলস বা হেমোরয়েড এর লক্ষণ সমূহঃ
- মলদার হতে রক্তপাতঃ লাল রক্ত ফোটায় ফোটায় বা তীরের মতো ছুটতে পারে।
- মলত্যাগের সময় বোটের মতো কিছু বের হয়ে আসতে পারে (প্রথম ডিগ্রী ছাড়া)
- মলদারে চুলকানি।
- মলদারে ব্যাথাঃ চতুর্থ ডিগ্রী পাইলস ও রক্ত জমাটকৃত বাহিরের পাইলসে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
পাইলস বা হেমোরয়েড কি কি কারণে হতে পারেঃ
- দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য বা পাতলা পায়খানা।
- অধিক সময় ধরে মলত্যাগ ও মল ত্যাগে বেশী চাপ দেয়া।
- গর্ভাবস্থা
- বংশগত
- বয়সজনিত
- শাক সবজি ও অন্যান্য আঁশযুক্ত খাবার এবং পানি কম খাওয়া।
- মাংশ জাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড, বেশি মসলাযুক্ত, ঝাল ও চর্বি জাতীয় খাবারা।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন।
- লিভার সিরোসিস।
পাইলস বা হেমোরয়েড নির্ণয়ঃ
একজন কলোরেক্টাল সার্জন রোগীর সাথে কথা বলে ও রোগীকে শারীরিক ভাবে পরীক্ষা করেই পাইলস বা হেমোরয়েড নির্ণয় করা যায়। পলিপ, ক্যান্সার বা আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগের উপস্হিতি নির্ণয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
পাইলস বা হেমোরয়েড রোগের চিকিতসাঃ
পাইলস চিকিতসার আগে একজন কলোরেক্টাল সার্জন দেখিয়ে অবশ্যই পলিপ বা ক্যান্সার যে নেই, তা নিশ্চিত হওয়া উচিৎ। অনেকেই তা না করে সাধারণ ডাক্তার দেখিয়ে আন্দাজে পাইলসের ঔষধ খেয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো ভুল চিকিতসার পরিনামে ক্যান্সার লিভারে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। ফলস্রুতিতে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তাই শুরুতেই সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন। জানতে হবে প্রাইস এখন কোন স্টেজে আছে।
প্রথম ডিগ্রী পাইলসঃ প্রথম ডিগ্রী পাইলসে চিকিতসাতেই ভাল হয়। এক্ষেত্রে করণীয়ঃ
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনঃ
- বেশি করে পানি ও আশযুক্ত খাবার (শাক-সবজি, ইসবগুলের ভূষি ও পাকা বেল)
- বেশি সময় ধরে মলত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন।
- মল নরম করার ঔষধ সেবন।
- পাইলসের খাবার ঔষধ
- সিজ বাথ
- মলম ব্যবহার।
দ্বিতীয় ডিগ্রী পাইলসঃ এই ধরনের পাইলসের জন্য লেজার সার্জারী, রাবার ব্যান্ড/রিং লাইগেশন, ডপলার গাইডেড পাইলসের রক্তনালী বাধা অথবা ইঞ্জেকশন স্ক্লেরোথেরাপি বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে না।
তৃতীয় ডিগ্রী পাইলসঃ এ ক্ষেত্রে লঙ্গো, লেজার, ডপলার গাইডেড পাইলসের রক্তনালী বাধা অথবা কেটে অপারেশন করার প্রয়োজন হয়।
চতুর্থ ডিগ্রী পাইলসঃ চতুর্থ ডিগ্রীতে STARR অথবা কেটে অপারেশন করা লাগে।
পাইলসের চিকিৎসার নাম ও তার কাজঃ
পাইলসের রাবার ব্যান্ড/রিং লাইগেশনঃ
এই পদ্ধতিতে রোগীকে কোন রকম হাসপাতালে ভর্তি, অজ্ঞান করা ও কাটা ছেড়ার প্রয়োজন হয় না।
পাইলসের গোড়ায় যন্ত্রের সাহায্যে একটি ব্যান্ড বা রিং বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর রোগী সাথে সাথেই হেটে যেতে পারে। পাচদিনের মধ্যে পাইলস খসে পড়ে যায়। কোন প্রকার ব্যাথা হয় না।
পাইলসের লঙ্গো অপারেশনঃ
ইটালির বিখ্যাত কলোরেক্টাল সার্জন স্যার এন্টনিও লঙ্গো মেসিনের সাহায্যে এই অপারেশন আবিস্কার করেন তাই তার নামে এই অপারেশনের নাম করণ করা হয়েছে। লঙ্গো অপারেশনে বাইরে কোন রকম কাটাছেড়া ছাড়াই পাইলস অপারেশন করা হয়। ফলে তেমন কোন ব্যথা হয় না এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয়।
কেটে পাইলস অপারেশনঃ
চতুর্থ ডিগ্রী ও বাইরের পাইলসে অনেক সময় কেটে অপারেশন করা লাগে। এর জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে ও সিজারের মত কোমরে ইঞ্জেকশন দিয়ে অবস করা লাগে। তিন বা ততোধিক জায়গায় কেটে পাইলস অপারেশন করলে অনেক ব্যাথা হয়। এছাড়া ঘা শুকানোর সময় মলদারের ছিদ্র ছোট হয়ে আসে।
লেজার অপারেশনঃ লেজার অপারেশনেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও সিজারের মত কোমরে ইঞ্জেকশন দিয়ে অবস করা লাগে। কোন কাটা ছেড়া করা লাগেনা, রক্তপাত হয়না এবং রোগী দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে।
কলোরেক্টাল সার্জন কি?
কলোরেক্টাল সার্জন হচ্ছেন পায়ুপথ, মলাশয়, বৃহদান্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্র এর সকল রোগের চিকিতসা ও অপারেশনে বিষেশজ্ঞ। তিনি কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের উপর এমএস ডিগ্রী করেছেন কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের শিক্ষক। বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় কয়েক জন মাত্র এম এস কলোরেক্টাল সার্জন রয়েছেন। একজন কলোরেক্টাল সার্জন এসব রোগ সম্পর্কে দীর্ঘদিন পড়ালেখা ও গবেষণা করেছেন তাই তিনি এসব বিষয়ে ডিটেইল জানেন এবং তাদের ভুল করার সম্ভাবনা কম। একজন কলোরেক্টাল সার্জন যেসব রোগের চিকিৎসা করেনঃ পাইলস, কোলন ক্যান্সার, রেক্টাম/মলাশয় ক্যান্সার, পলিপ, এনাল/মলদারের ক্যান্সার, ফিস্টুলা, ফোঁড়া, এনাল ফিসার, রেক্টাল প্রোলাপ্স (হালিশ), কোষ্ঠকাঠিন্য, মলত্যাগে বাধাগ্রস্ততা, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যাথা, আইবিএস, আলসারিটিভ কোলাইটিস, ক্রনস ডিসিস, পেটের ও মলদারের যক্ষা, বমি, পেট ফাঁপা, পেট ফোলা, বদ হজম, পেটে গ্যাস, মলদারে রক্ত যাওয়া, মলদারে ব্যাথা, পাইলোনিডাল সাইনাস, বিনা অপারেশনে পাইলসের চিকিৎসা, লেজার চিকিৎসা, কলোনস্কপি, রাবার ব্যান্ড/রিং লাইগেশন, ইঞ্জেকশন স্কেরোথেরাপি, লঙ্গো, STARR, ফিস্টুলা সার্জারী, ল্যাপারোস্কপিক রেক্টোপেক্সি, মলদার রেখেই কোলন ও রেক্টাম ক্যান্সার অপারেশন ইত্যাদি।
লেখক পরিচিতিঃ
ডা. তারিক আখতার খান
- এমবিবিএস, এফসিপিএস (সার্জারী), এমএস (কলোরেক্টাল সার্জারী), এফআরসিএস (গ্লাসগো)।
- সহকারী অধ্যাপক, কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।
- কনসালটেন্ট – কলোরেক্টাল ও এন্ডো-লেপারোস্কপিক সার্জারী, বি আর বি হাসপাতাল।
ডা. তারিক আখতার খান ২০০০ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও ২০১০ সালে সার্জারীতে এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। আবাসিক সার্জন হিসেবে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, কুষ্টিয়াতে ২০১০-২০১৩ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি কনসালটেন্ট (সার্জারী) হন। ২০১৪ সাল থেকে বিএসএমএমইউ সহ ঢাকা ও ঝিনাইদহে কলোরেক্টাল সার্জন হিসেবে কাজ করেন। তিনি কলোরেক্টাল ক্যান্সারের উপর থিসিস করেছেন। ২০১৮ সালে কলোরেক্টাল সার্জারীতে এম এস ডিগ্রী এবং ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক ফেলোশিপ রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স এন্ড সার্জন্স অফ গ্লাসগো থেকে এফআরসিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে কর্মরত আছেন।
তিনি ‘আমেরিকান সোসাইটি অফ কোলন এন্ড রেক্টাল সার্জনস’ এর সদস্য। তিনি এসোসিয়েশন অফ কোলন এন্ড রেক্টাল সার্জন্স অফ ইন্ডিয়া এবং আর্ন্তজাতিক কলোপ্রক্টলজী সোসাইটির আজীবন সদস্য ও ফেলো। কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ক তাঁর গবেষণালব্ধ ৯টি প্রবন্ধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৭ সালে কলোরেক্টাল বিষয়ক তার গবেষনা প্রবন্ধ ইন্ডিয়াতে পুরস্কার অর্জন করে।
শেষ কথা
পরিশেষে বলা যায় যে, সাধারণত পাইলস বা অর্শ্ব রোগের জন্যে আপনাকে যে কোন ক্ষেত্রেই বেছে নিতে হবে একটি সহজতর জীবনব্যবস্থা। কেননা পাইলসের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। আর একে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে একটি সুস্থ খাদ্য বৃত্তান্তের মধ্যে চলে আসতে হবে। পাইলসের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে তাই আজ থেকেই শুরু করে দিন আপনার যাত্রা।