পাইলস কি?
পাইলস বলতে সাধারণ জনগন মলদারের যে কোন সমস্যাকেই বুঝিয়ে থাকে। কিন্তু ডাক্তারী ভাষায় পাইলস বলতে হেমোরয়েড নামের একটি নিদিষ্ট রোগকেই বুঝানো হয়। মলদারে পাইলস ছাড়াও এনাল ফিসার, ফোড়া ও ফিসটুলা ,পলিপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। মলদারের রোগ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে যেমন খুবই ভালো ফলাফল তেমনি অবহেলা করলে মারাত্মক ভোগান্তিকর হতে পারে। পাইলস (হেমোরয়েড) রোগে মলদারের ভিতর থেকে রক্তনালীর একটি পিন্ড ফুলে যায় ও কখনো কখনো বাইরে বের হয়ে আসে। পাইলস রোগে সাধারণত মলদারে ব্যাথা হয় না। তবে জটিলতা হলে ব্যথা হতে পারে। গ্রাম বাংলায় এই রোগ অর্শ নামে বহুল পরিচিত।
পাইলসের প্রকারভেদঃ
পাইলস বা হেমোরয়েড দুই ধরনের হয়ঃ
১। ভিতরের পাইলসঃ রক্তনালীর পিন্ড কতখানি বের হয়ে আসে তার উপর ভিত্তি করে ভিতরের পাইলসকে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ডিগ্রীতে ভাগ করা হয়।
২। বাহিরের পাইলসঃ এটি মলদারের বাইরের চামড়া দারা আবৃত। এটির মধ্যে রক্ত জমাট বাধলে এটি ফুলে যায়।
পাইলস বা হেমোরয়েড এর লক্ষণঃ
· মলদার হতে রক্তপাতঃ লাল রক্ত ফোটায় ফোটায় বা তীরের মতো ছুটতে পারে।
· মলত্যাগের সময় বোটের মতো কিছু বের হয়ে আসতে পারে (প্রথম ডিগ্রী ছাড়া)
· মলদারে চুলকানি।
· মলদারে ব্যাথাঃ চতুর্থ ডিগ্রী পাইলস ও রক্ত জমাটকৃত বাহিরের পাইলসে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
অপারেশন ছাড়া পাইলস বা হেমোরয়েড রোগের চিকিতসাঃ
পাইলসের চিকিৎসা কিছু সহজ ও সাধারণ চিকিৎসা আছে যা সকল প্রকার পাইলসেই কাজ করে। যেমনঃ
· খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনঃ বেশি করে পানি পান করতে হবে। শীতকালে রোজ ২-৩ লিটার এবং গরমকালে ৩-৪ লিটার পানি পান করা ভালো। তবে কিডনী ও হার্টের রোগী তার ডাক্তারের পরামর্শ মত পানি পান করবেন। বেশি করে আশযুক্ত খাবার যেমন শাক-সবজি, ইসবগুলের ভূষি, পাকা বেল, ফল খেতে হবে।
· বেশি সময় ধরে মলত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তনঃ ৫-৭ মিনিটের মধ্যে পায়খানা শেষ করা ভালো। অনেকে পায়খানা করতে ২৫-৩০ মিনিট লাগিয়ে থাকেন। এরকম হলে অবশ্যই একজন কলোরেক্টাল সার্জন দেখাবেন।
· মল নরম করার ঔষধঃ পাইলসের জন্য মল বেশী শক্ত ও বেশী পাতলা উভয়ই খারাপ। মল মাঝারী ধরনের রাখাই সবচেয়ে ভালো। কিছু ঔষধ আছে যেগুলো দীর্ঘ দিন ধরে খাওয়া যায় এবং কোন ক্ষতি হয়না। আবার কিছু ঔষধ আছে যেগুলো নিয়মিত খেলে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। তাই আপনি যে ঔষধ খাচ্ছেন তা ক্ষতিকারক কিনা আপনার ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন।
· পাইলসের খাবার ঔষধঃ ঔষধে পাইলস সারানোর জন্য বাজারে বিভিন্ন প্রকারের ঔষধ পাওয়া যায়। কিছু ঔষধ খুবই কার্যকারী। এসব ঔষধ খাবার আগে একজন কলোরেক্টাল সার্জন দেখিয়ে অবশ্যই পলিপ বা ক্যান্সার যে নেই, তা নিশ্চিত হওয়া উচিৎ। অনেকেই তা না করে সাধারণ ডাক্তার দেখিয়ে আন্দাজে পাইলসের ঔষধ খেয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো ভুল চিকিতসার পরিনামে ক্যান্সার লিভারে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। ফলস্রুতিতে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
· প্রথম ডিগ্রী পাইলস অপারেশন ছাড়া এসব চিকিতসাতেই ভাল হয়।
· দ্বিতীয় ডিগ্রী পাইলসে উপরোক্ত সব চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু পদ্ধতি করা লাগে; এসবের মধ্যে রয়েছে রাবার ব্যান্ড/রিং লাইগেশনঃ এই পদ্ধতিতে রোগীকে কোন রকম হাসপাতালে ভর্তি, অজ্ঞান করা ও কাটা ছেড়ার প্রয়োজন হয় না। পাইলসের গোড়ায় যন্ত্রের সাহায্যে একটি ব্যান্ড বা রিং বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর রোগী সাথে সাথেই হেটে যেতে পারে। পাচ/ছয় দিনের মধ্যে পাইলস খসে পড়ে যায়। কোন প্রকার ব্যাথা হয় না। এছাড়াও রয়েছে ইঞ্জেকশন স্ক্লেরোথেরাপি। এসব চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে না।
· তৃতীয় ডিগ্রী পাইলসে উপরে লেখা সাধারণ চিকিতসায় আপাতত ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত অপারেশন করা লাগে। তবে আজকাল না কেটেও অপারেশন করার ব্যাবস্থা রয়েছে যেমনঃ লঙ্গো, লেজার, ডপলার গাইডেড পাইলসের রক্তনালী বাধা ইত্যাদি।
· চতুর্থ ডিগ্রী পাইলসে মেশিনে STARR অথবা কেটে অপারেশন করা লাগে। কিন্তু আপনি যদি এখন অপারেশন না করে পরে অপারেশন করতে চান; সেক্ষেত্রে উপরে লেখা পাইলসের সাধারণ চিকিৎসার সাথে সিজ বাথ নিতে হয়। একটি বড় প্লাস্টিকের গামলায় তিন লিটার কুসুম গরম পানিতে দুই টেবিল চামচ খাবার লবন মিশিয়ে মলদার ডুবিয়ে ১০ মিনিট বসবেন। এভাবে রোজ ২-৩ বার করে দুই সপ্তাহ বসলে পাইলস অনেকটাই ছোট হয়ে আসে। এছাড়াও পাইলসের কিছু লাগানো মলম আছে যেগুলোতেও উপকার পাওয়া যায়।
· বাইরের পাইলসে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী কোন অসুবিধা বোধ করে না এবং কোন চিকিৎসা লাগে না। তবে এটি অনেক সময় ফুলে যায়। সেক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি সিজ বাথ নিলে ৫-৭ দিনের মধ্যেই ব্যাথা চলে যায় এবং ফোলাও অনেক কমে আসে। তবে অনেক বড় পাইলসের জন্য অপারেশন ভালো।
কলোরেক্টাল সার্জন কি?
কলোরেক্টাল সার্জন হচ্ছেন পায়ুপথ, মলাশয়, বৃহদান্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্র এর সকল রোগের চিকিতসা ও অপারেশনে বিশেষজ্ঞ। তিনি কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের উপর এমএস ডিগ্রী করেছেন কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলোরেক্টাল সার্জারী বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন অথবা কর্মরত ছিলেন। একজন কলোরেক্টাল সার্জন এসব রোগ সম্পর্কে দীর্ঘদিন পড়ালেখা ও গবেষণা করেছেন তাই তিনি এসব বিষয়ে ডিটেইল জানেন এবং তাদের ভুল করার সম্ভাবনা কম।
লেখক পরিচিতি
ডাঃ তারিক আখতার খান। এফসিপিএস (সার্জারী), এমএস (কলোরেক্টাল সার্জারী), এফআরসিএস (গ্লাসগো)। সহকারী অধ্যাপক, কলোরেক্টাল সার্জারী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট, কলোরেক্টাল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জারী, বিআরবি হাসপাতাল, পান্থপথ, ঢাকা।