এনাল ফিসার আজকালকার দিনে একটি খুবই সাধারণ সমস্যা। সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য মলত্যাগের সময় মলদ্বারে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের কারণে মলদ্বারের ফেটে যাওয়াকেই এনাল ফিসার বলে। হরহামেশাই ঘটে যাওয়া সমস্যা হলেও এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে নানানভাবে ব্যাহত করে। আজ আমরা জানবো এনাল ফিসার হওয়ার কারণ, লক্ষণ, ক্ষতিকর দিকসমূহ এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে।
এনাল ফিসার কি?
আমরা সকলেই কমবেশি কৌষ্ঠকাঠিন্যে ভুগে থাকি। অনেক সময় কৌষ্ঠকাঠিন্য হলে মলদ্বারে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের ফলে মলদ্বারের চামড়া ফেটে যায়। সাধারনত আমাদের মলদ্বার নিজে থেকেই এই ক্ষতি সারিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য বার বার একই জায়গা আক্রান্ত হওয়ার ফলে সেই কাটা জায়গাটি দিন দিন প্রসারিত হতে থাকে এবং ক্রমশ নিজে থেকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখনই একজন রোগীকে ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হয়।
যত দিন যায় এর ব্যাথার তীব্রতা এবং ভোগান্তি বাড়তে থাকে। এর ফলে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজকর্ম ব্যাহত হয়। অনেকেই আছেন মলদ্বারের রোগ বলে এটি কাউকে জানাতে অথবা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে লজ্জা পান।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই কাটা জায়গা অথবা আক্রান্ত জায়গাটির রক্তচলাচল কমে আসে। ফলাফল সরুপ এটি দীর্ঘমেয়াদী একটি সমস্যায় রুপ নেয়। কারন রক্তচলাচল কমার কারনে এটি নিজ থেকে সেরে উঠার সম্ভাবনা আরও কমে যায়। আর কোষ্ঠকাঠিন্য যদি সমধান না করা যায় তখন আরো খারাপ দিকে রুপ নেয় এই এনাল ফিসার।
তাই যত তাড়িতাড়ি সম্ভব এই রোগের চিকিৎসা করা বাঞ্ছনীয় যার জন্য জানতে হবে এই এনাল ফিসারের লক্ষন সমুহ।
এনাল ফিসারের লক্ষন সমুহ
১. মলত্যাগের সময় ব্যাথা অনুভুত হওয়াঃ
সাধারন এনাল ফিসারের কারনে মলত্যাগের সময় মলদ্বারে প্রচন্ড পরিমানে ব্যাথা অনুভব হয়। তীক্ষ্ণ, ধারানো,ছুড়ি দিয়ে কাটার মতো এই ব্যাথা মাঝেমাঝেই সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। পানি ব্যাবহারে অথবা মলদ্বারে কম চাপ প্রয়োগ করা কোনভাবেই সহসা এই ব্যাথা থেকে মুক্তি লাভ হয়না। ফলস্বরূপ দীর্ঘক্ষণ এই ব্যাথা চলতে পারে যা রোগীর দৈনন্দিন জীবনকে নানান ভাবে ব্যাহত করে।
২. মলদ্বার দিয়ে রক্ত যাওয়াঃ
রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে রক্তপাত হওয়ার সম্ভাভাবনা রয়েছে। তবে এনাল ফিসারে রক্তপাত হওয়াটা সাধারনত সবার ক্ষেত্রে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাথাটাই হয় মূল সমস্যা। তবে যদি রক্তপাত হয় সেটা হয় লাল রঙের তাজা রক্ত।
পায়ুপথের চামড়া এবং মাংস কেটে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট এই রক্তপাত কাছাকাছি জায়গায় হওয়াতে এটির রঙ লাল হয়। তবে পায়ুপথ দিয়ে বের হওয়া এই রক্ত যদি কালচে বা অন্য রঙের হয় তাহলে তা এনাল ফিসারের জন্য হয়নি বলেই ধরে নিতে হবে। এর পিছনে কোলন ক্যান্সার, আলসারের মত নানান রোগের ভুমিকা থাকতে পারে।
৩. মলদ্বারের চামড়া ঝুলে পড়াঃ
সাধারনত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে এনাল ফিসার একা একাই ভাল হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে যে জায়গায় ফিসারটি অবস্থিত ছিল সেই জায়গার চামড়ার ছোট একটা অংশ ঝুলে পড়ে। তাই এই ঝুলে পড়া অংশ আসলে এটাই বোঝায় যে সেখানে একটি এনাল ফিসার ছিল যেটা ভাল হয়ে গিয়েছে।
৪. মলদ্বারে চুলকানীঃ
এনাল ফিসারে চুলকানী হতে পারে। সেইক্ষেত্রে মলদ্বারে গরম পানি ব্যাবহারে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।
এনাল ফিসার কেনো হয়?
নির্দিষ্ট কিছু কারনে এনাল ফিসার হয়ে থাকে। নিম্নে কারনগুলো তুলে ধরা হলোঃ
১. কোষ্ঠকাঠিন্যঃ
এনাল ফিসার হওয়ার মুল কারন হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। দৈনন্দিন রুটিনে ফাইবার বা আশ জাতীয় খাবারের সল্পতা, কার্বোহাইড্রেট ও লাল মাংশ জাতীয় খাবারের আধিক্য এসব কারনেই সাধারণত কৌষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা লেগেই থাকে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমান পানি পান না করা, দীর্ঘক্ষণ পায়খানা চেপে রাখা এসব কারনেও এনাল ফিসারের সমস্যা খারাপ আকার ধারন করতে পারে।
২. দীর্ঘকালীন ডায়রিয়াঃ
ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়ার কারনেও এনাল ফিসার হতে পারে। অনেকেই ডায়রিয়াকে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত ডায়রিয়ায় ভুগলে অবশ্যই আপনাকে সচেতন হতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়ার চিকিৎসা করতে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট অথবা কলোরেক্টাল সার্জন দেখাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
৩. খাদ্যনালীর প্রদাহঃ
খাদ্যনালীর প্রদাহ যেমন ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিস, ক্রোনস ডিজিস এসব কারনেও এনাল ফিসার হয়ে থাকতে পারে। সেইক্ষেত্রে চিকিৎসা মোটেও দেরি করা উচিত নয়। কারন এই রোগসমুহ যেকোন সময় মারাত্নক আকার ধারন করতে পারে এমনকি মৃত্যুরও কারন হতে পারে।
৪. যৌনবাহিত রোগঃ
অনেক সময় কিছু যৌনবাহিত রোগ যেমন সিফিলিস, হারপিস এসব কারনেও এনাল ফিসার হতে পারে।
৫. সমকামিতা অথবা এনাল সেক্স
এনাল সেক্স বা পুরুষ সমকামীতা এনাল ফিসার হওয়ার অন্যতম কারন। এই অভ্যাস থেকে বিরত থাকতে হবে।
৬. প্রেগ্ন্যাসিঃ
গর্ভকালীন সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রায়ই দেখা যায়, যেটা এনাল ফিসারের সম্ভাবনা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়।
এনাল ফিসার প্রতিরোধের উপায়
১. ফাইবার বা আশ জাতীয় খাবার খাওয়াঃ
পায়খানা নরম রাখতে ফাইবার বা আশ জাতীয় খাবার খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। শাকসবজি এবং ফলমুলে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার বিদ্যমান যা পায়খানা নরম রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া ওট্মিল, লাল আটা, বাদাম, ডাল, বার্লি ইত্যাদি খাবারেও প্রছুর পরিমানে ফাইবার থাকে।
২. পর্যাপ্ত পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খাওয়াঃ
পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করলে তা আমাদের হজমে সহায়তা করে এবং পরিপাকতন্ত্রকে ভালো রাখে। তাছাড়া পায়খানা নরম রাখতে বেশি বেশি পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই। পানিজাতীয় খাবার যেমন ডাবের পানি, স্যুপ, শরবত, রসালো ফল এসব বেশি করে খাওয়া যেতে পারে।
৩. ইসবগুলের ভুষিঃ
ইসবগুলের ভুষি পায়খানা নরম রাখার অন্যতম নিয়ামক। প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ ইসব গুল মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
৪. দীর্ঘক্ষন পায়খানা চেপে না রাখাঃ
পায়খানার চাপ হলে তা চেপে রাখা যাবে না। বেশিক্ষন পায়খানা চেপে রাখলে তা শক্ত হয়ে যায় যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ফলাফল সরুপ এনাল ফিসার হয়।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম করাঃ
প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে ব্যায়াম করলে বাওয়েল মুভমেন্ট বাড়ে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলা যায়, এবং এনাল ফিসার থেকে মুক্ত থাকা যায়।
৬. মলদ্বার পরিস্কার রাখাঃ
প্রতিবার পায়খানার পর মলদ্বার ভাল করে পরিস্কার রাখতে হবে। ভেজা বা অপরিস্কার কাপড় পরিধান করা যাবে না।
এনাল ফিসার থেকে বাচতে এই দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
এনাল ফিসারের চিকিৎসা
মলদ্বার ফিসারের জন্য সাধারনত যেই চিকিৎসাগুলো প্রয়োগ করা হয়ঃ
- ব্যথা উপশমকারী ওষুধ
- ল্যাক্সেটিভ
- চেতনানাশক ক্রিম
- পেশীর খিঁচুনি শিথিল করতে নাইট্রোগ্লিসারিন ক্রিম বা বোটক্স ইনজেকশন
- অস্ত্রোপচার
মলদ্বারের ব্যাথার ঘরোয়া চিকিৎসা
১. গরম পানি ব্যাবহার করাঃ
কুসুম গরম পানিতে ২ চামচ লবন মিশিয়ে পায়খানার রাস্তায় ব্যাবহার করলে তাৎক্ষনিক ভাবে ব্যাথা উপশম হয়। তাছাড়া এটি মলদ্বারকে পরিস্কার রাখতেও সহায়তা করে
২. ব্যাথানাশক ঔষধঃ
সাধারন ব্যাথানাশক ঔষধ যেমন প্যারাসিটামল, আইবোপ্রফেন জাতীয় ঔষধ সেবন করলে ব্যাথা অনেকাংশেই কমে যাবে। সাথে মলদ্বারের ফোলাভাব কমে যাবে।
৩. মলদ্বারে গ্লিসারিন ব্যাবহার করাঃ
পায়খানার পুর্বে মলদ্বারে গ্লিসারিন বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যাবহার করলে পায়খানার রাস্তা মসৃন হয়, যা ব্যাথা কমায়।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কিছু স্বাস্থ্যকর অন্ত্রের অভ্যাস গড়ে তুলুনঃ
কিছু অভ্যাস আপনার মলদ্বারে চাপ কমিয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করবে। বেদনাদায়ক এনাল ফিসার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত এই অভ্যাসগুলি অনুশীলন করুনঃ
- বাথরুম ব্যবহার করার সময়, আরামদায়ক অবস্থায় মলত্যাগ করার জন্য নিজেকে যথেষ্ট সময় দিন। তবে টয়লেটে বেশিক্ষণ বসে থাকবেন না।
- মলত্যাগ করার সময় অতিরিক্ত চাপ দেবেন না।
- পায়ু অঞ্চল শুকনো রাখুন।
- প্রত্যেকবার মলত্যাগের পরে নিজেকে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করুন।
- নরম, রঞ্জক মুক্ত এবং ঘ্রাণ-মুক্ত টয়লেট পেপার বা ওয়াইপ ব্যবহার করুন।
- দীর্ঘদিন যাবত ডায়রিয়ায় ভুগলে তার জন্য চিকিৎসা করান।
এনাল ফিসারের ঝুঁকি কাদের বেশি?
মলদ্বারে ফাটল বা এনাল ফিসার যে কোনো বয়সে যে কারোরই হতে পারে। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পায়ুপথে ফিসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে অতীতে যাদের ফিসার হয়েছে তাদের ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কিছু রোগের সাথে এই এনাল ফিসার প্রায়ই দেখা যায়, যেমন:
- মলদ্বার ক্যান্সার
- লিউকেমিয়া
- এসটিডি এবং এইচআইভি
- ক্রোনস বা আলসারেটিভ কোলাইটিসের মতো অন্যান্য অবস্থার জটিলতা
এনাল ফিসার থেকে কি ক্যান্সার হয়?
মলদ্বারের ফাটল কোলন ক্যান্সার সৃষ্টি করে না বা কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে কোলন ক্যান্সারের কারণেও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে এনাল ফিসার হতে পারে। দীর্ঘদিন ফিসার থেকে মলদারের ফিস্টুলা রোগ হতে পারে।
যদি আপনার এনাল ফিসার চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো না হয় বা ফিরে আসে, তাহলে আপনাকে অবশ্যই একজন পায়ুপথের ডাক্তার বা কলোরেক্টাল সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে।
শেষকথা
মলদ্বারের ফাটল বেদনাদায়ক এবং অস্বস্তিকর হতে পারে, তবে সেগুলি সাধারণত গুরুতর হয় না। আপনার যদি পায়ুপথে ফাটল থাকে, তাহলে আপনি ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে সহজেই উপশম পেতে পারেন। যেমন আপনার খাবারে ফাইবার বৃদ্ধি, পানি পান করা অথবা মল সফটনার ব্যবহার করে। যদি ঘরোয়া চিকিৎসায় যদি কোনো উপকার না হয়, তবে আপনার ডাক্তার আপনাকে অন্যান্য চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন, যেমন ওষুধ বা অস্ত্রোপচার।
সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে, আপনি আপনার মলদ্বারের ফাটল থেকে মুক্তি পেতে পারেন এবং পুনরায় আপনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।
রোগী দেখাতে ও এপয়েন্টমেন্ট নিতে সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ টার ভিতর ফোন করুনঃ ০১৮৫০৩৮৮৩২৯ (রাসেল), ০১৯৮৫৮৬০৬৯০ (তৌহিদ), ০১৭৩৬৩৬৯৫৩৬ (ফারহানা)