কোলনস্কপি কী, কেন, কখন এবং কীভাবে করা হয়?
পায়ুপথ, মলদ্বার ও বৃহদান্ত্রে যাদের সমস্যা রয়েছে তাদের অনেককেই ডাক্তার কোলনস্কোপি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডাক্তারের পরামর্শ পেয়ে অনেকেই জানতে চান যে, কোলনস্কপি কী, কেন, কখন এবং কীভাবে করতে হয়? এটি কী জটিল ও ব্যয়বহুল টেস্ট না-কি অন্যান্য সাধারণ টেস্টগুলোর মতই একটি টেস্ট?
কোলনস্কোপি নিয়ে মনে জমে থাকা যত কৌতুহল ও প্রশ্ন আছে, এসব দূর করতেই এই ব্লগ। ব্লগটিতে বৃহদান্ত্রের এই পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চলুন লেখাটি পড়তে শুরু করি এবং কোলনস্কোপি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
কোলনস্কপি (Colonoscopy) কী?
কোলনস্কোপি হলো Colon বা বৃহদান্ত্র, পায়ুপথ ও রেকটামের একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষার মাধ্যমে পায়ুপথ, মলদ্বার ও বৃহদান্ত্রের বিভিন্ন রোগ ডায়াগনোসিস করা হয়। এ পরীক্ষায় চিকন একটি নল বা স্কোপ মলদ্বার দিয়ে ঢোকানো হয় এবং এর সাথে যুক্ত কম্পিউটারে নাড়ির ভেতরের রোগসমূহ ছবিসহ রিপোর্ট করা হয়।
কোলনস্কপি কেন ও কখন করা হয়?
রোগী যখন পেট ও পায়ুপথের কোনো সমস্যায় ভোগেন সে সমস্যা নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকগণ কখনো কখনো কোলনস্কোপি করে থাকেন। যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি স্ক্রিনিংয়ের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ তাদের পলিপ বা ক্যান্সার আছে কি-না তা বুঝার জন্য এই টেস্ট করা হয়। এছাড়া আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রনস ডিজিজে রোগ ডায়াগনোসিস এবং ক্যান্সার রোগীর পরবর্তী ফলোআপের জন্য কোলনস্কোপি করা হয়।
কোলনস্কপি করার নিয়ম
চিকন একটি নল বা স্কোপ মলদ্বার দিয়ে ঢুকিয়ে কোলনস্কোপি পরীক্ষা করা হয়। স্কোপে সিসিডি বা ফাইবার অপটিক ক্যামেরা থাকে এবং এটিকে কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়। ফলে রোগীর নাড়ির ভেতরের রোগসমূহ ছবিসহ রিপোর্ট হয়ে যায়।
কোলনস্কপি করার প্রস্তুতি (Bowel Preparation)
পরীক্ষার আগের দিন শাক-সবজি, ফলমূল ও শসা ইত্যাদি আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। Colonoscopy test এর আগের রাতে খাবার পর তিনটা জোলাপের বড়ি একসাথে খেতে হবে। পরীক্ষার দিন সকালে দুধ, কলা, রুটি, ডিম ও বিস্কুট ইত্যাদি হালকা নাস্তা খাওয়া যাবে। সকালে ডাক্তার যে তরল ঔষধের পরামর্শ দিবেন সেটা গ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস ও প্রেসারের সমস্যা না থাকলে খাবার স্যালাইন খাওয়া ভালো।
পেটের সব মল পরিস্কার করার জন্য Colonoscopy test এর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রস্তুতি ভালো না হলে মলের নিচে পলিপ আলসারসহ অন্যান্য রোগের নমূনা ঢাকা পড়ে সঠিক রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়।
প্রস্তুতি ঠিক হয়েছে কি-না বুঝার উপায়
ঔষধ খাওয়ার পর আট থেকে দশবার পাতলা পায়খানা হবে। যখন দেখা যাবে যে পানির মতো পরিস্কার মল যাচ্ছে তখন বুঝতে হবে প্রস্তুতি সঠিক হয়েছে। পানির মতো মল তৈরি হতে সময় লাগলে ঘন ঘন খাবার স্যালাইন খেতে হবে। তবে বয়স্ক, কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
কোলনস্কপি করতে কত সময় লাগে?
বাতাস ও তরল ব্যবহার করে কোলনের মধ্যে কোলনস্কপটিকে নাড়াচাড়া করে থাকেন চিকিৎসক। কোলনের মধ্যে স্কোপ নাড়াচাড়া করেই রোগ নির্ণয় করে থাকেন তাঁরা। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ১০-২০ মিনিট সময় লাগে একজন চিকিৎসকের। তবে ডাক্তার ভেদে এ সময় কমবেশি হতে পারে।
কোলনস্কপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কোলনোস্কোপির পর কখনো কখনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সমস্যা বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিচে কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো:
- রক্তপাত: কোলনোস্কোপির মাধ্যমে যদি পলিপ অপারেশন করা হয়, তাহলে এরপর সামান্য রক্তপাত হতে পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এ রক্তপাত নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কারণে রক্তপাত বন্ধ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- পেটে ব্যাথা বা অস্বস্তি: কোলনস্কপির পর পেটে সামান্য অস্বস্তি বা ফোলাভাব অনুভব করা স্বাভাবিক। এ সমস্যা নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায়।
- বমি বমি ভাব: এ পরীক্ষা করার পর বমি বমি ভাব হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। এটাও নিজ থেকে ভালো হয়ে যায়।
- কার্ডিওভাসকুলার জটিলতা: যাদের হার্টের সমস্যা আছে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে তাদের কার্ডিওভাসকুলার জটিলতা হতে পারে। এজন্য পরীক্ষার আগে ডাক্তারের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়া উচিৎ।
কোলনস্কপির বিকল্প কি?
কোলনস্কপি হলো অত্যাধুনিক চিকিৎসা। সমসাময়িক সময়ে সাধারণত কেউ এর বিকল্প খোঁজ করে না। এরপরেও কিছু টেস্ট আছে যা Colonoscopy test এর বিকল্প হিসেবে করা হয়:
- ফ্লেক্সিবল সিগমায়েডোস্কোপি
- ভার্চুয়াল কোলনস্কপি (সিটি কোলোনোগ্রাফি)
- ফেকাল অকল্ট ব্লাড টেস্ট (এফওবিটি)
- ফেকাল ইমিউনোকেমিক্যাল টেস্ট (এফআইটি)
কোলনস্কপি কি ব্যথাদায়ক/ব্যাথামুক্ত কোলনস্কপি কিভাবে করা হয়?
অনেকেই জানতে চান যে কোলনস্কপি কি বেদনাদায়ক? বর্তমানে পরীক্ষা করার সময় রোগীকে হালকা করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় যাতে রোগী ব্যাথা না পায়। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর রোগী বুঝতেই পারে না কখন কোলনস্কপি করানো হয়েছে! হাজারে একটা কোলনস্কপিতে সমস্যা হতে পারে। রোগী ব্যাথা পেতে পারে। তবে এরও নিরাপদ সমাধান আছে।
কোলনস্কপির খরচ কত?
হাসপাতাল ও চিকিৎসকভেদে কোলনস্কপির খরচ নানান রকম হয়ে থাকে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২৫০ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে নূন্যতম ৬ হাজার টাকা থেকে খরচ শুরু হয়।
শর্ট কোলনস্কপি কী?
শর্ট কোলনস্কপি হল এমন পদ্ধতি যেখানে কোলনের একটি অংশ পরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসক যখন রোগীর পুরো কোলন পরীক্ষা করা অপ্রয়োজনীয় বা ঝূঁকিপূর্ণ মনে করেন তখন শর্ট কোলনস্কপি করে থাকেন।
কোলনস্কপি করালে উপকার হয় কি?
কোলনস্কপি করালে পায়ুপথ, মলদ্বার ও বৃহদান্ত্রে কোনো রোগ থাকলে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়। কোলন বা রেক্টামে পলিপ পাওয়া গেলে তা অপসারণ করে রোগীকে ক্যান্সার থেকে রক্ষা করা যায়। ক্যান্সার থেকে থাকলে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়। অর্থাৎ কোলনস্কপিতে উপকারই বেশি।
কোলনস্কপি করেন কোন বিশেষজ্ঞ?
কোলনস্কপি করাতে হবে কি-না এ বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য শরণাপন্ন হতে হবে একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কলোরেকটাল সার্জনের। কলোরেকটাল সার্জন রোগীর সমস্যা শুনে সিদ্ধান্ত নেন যে, কোলনস্কপি করাতে হবে না-কি অন্য কোনো পরীক্ষা করে রোগ ডায়াগনোসিস করতে হবে।
ডাক্তার তারিক আখতার খান কোলনস্কপি ও পায়ুপথ, মলাশয়, বৃহদান্ত্র ও ক্ষুদ্রান্তের সকল রোগের চিকিৎসা ও অপারেশনে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কলোরেকটাল সার্জন। তিনি রয়েল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস এবং সার্জনস অফ গ্লাসগোর একজন ফেলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলোরেকটাল সার্জারি বিষয়ের উপর এমএস ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি ইতোপূর্বে শহীদ সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজে ও বর্তমানে মুগদা মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা করছেন। দক্ষ হাতে কোলনস্কপি করাতে ১৫ বছরের অধিক অভিজ্ঞ এ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং নিজেকে সুস্থ রাখুন।