অ্যানাল ফিস্টুলা (Anal Fistula) হলো মলদ্বারের একটি জটিল, অস্বস্তিকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যা
মলদ্বার ও বাইরের ত্বকের মাঝে একটি অস্বাভাবিক টানেল বা রাস্তা তৈরি করে। এই টানেল দিয়ে নিয়মিত অথবা
মাঝে মধ্যে পুঁজ, রক্ত বা তরল বের হয় এবং তীব্র ব্যথা ও অস্বস্তি তৈরি করে। এটি সাধারণত পুরনো
ইনফেকশন বা অ্যানাল অ্যাবসেসের জটিলতা হিসেবে শুরু হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল রূপ ধারণ করে।
অনেক সময় রোগীরা একে পাইলস বলে ভুল করেন, অথচ পাইলস ও ফিস্টুলা একেবারেই আলাদা রোগ। সময়মতো চিকিৎসা
না করলে এই টানেলের চারপাশে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটে।
বাংলাদেশে এ ধরনের মলদ্বার-সম্পর্কিত রোগে ভোগা রোগীর সংখ্যা কম নয়, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ লজ্জা,
ভয় বা অজ্ঞতার কারণে চিকিৎসা গ্রহণে দেরি করেন। অনেকে নিজে নিজে ওষুধ খেয়ে বা দেশি উপায়ে উপশমের
চেষ্টা করেন, যা অধিকাংশ সময়ই সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। অথচ আধুনিক চিকিৎসায় অ্যানাল ফিস্টুলা
নিরাময়যোগ্য, এবং দক্ষ সার্জনের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা পেলে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে
পারেন।
এই ব্লগে আমরা সহজভাবে জানাবো অ্যানাল ফিস্টুলা কেন হয়, কী লক্ষণ দেখে বুঝবেন, চিকিৎসার উপায় কী এবং
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
অ্যানাল ফিস্টুলা সাধারণত মলদ্বার সংলগ্ন কোনো গ্ল্যান্ডে সংক্রমণ বা পুঁজ জমার (অ্যানাল অ্যাবসেস)
কারণে তৈরি হয়। যখন মলদ্বারের ভেতরের গ্রন্থিতে ইনফেকশন হয়, তখন সেখানে পুঁজ জমে এবং তা বাইরে বের
হওয়ার জন্য একটি টানেল তৈরি করে, যেটিই পরবর্তীতে ফিস্টুলায় পরিণত হয়। নিচে অ্যানাল ফিস্টুলার কিছু
সাধারণ কারণ দেওয়া হলো:
অ্যানাল অ্যাবসেস: সবচেয়ে সাধারণ বা প্রচলিত কারণ। পুঁজ জমে গিয়ে তা বাইরে বের হতে গিয়ে
একটি ফিস্টুলা পথ তৈরি করে।
ক্রনস ডিজিজ:ক্রনস ডিজিজ একটি দীর্ঘস্থায়ী
অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ, যা মলদ্বারে
সংক্রমণ সৃষ্টি করে জটিল ফিস্টুলা তৈরি করতে পারে।
যক্ষ্মা (টিবি): টিবি রোগীর মলদ্বার অঞ্চলে সংক্রমণ হলে ফিস্টুলা তৈরি হতে পারে, যদিও
এটি তুলনামূলকভাবে বিরল।
রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিয়েশন টিস্যুর ক্ষতি করে ফিস্টুলার ঝুঁকি
বাড়াতে পারে।
পূর্বের অস্ত্রোপচার: পাইলস বা অন্য কোনো অপারেশনের পর যদি ইনফেকশন হয়, তাহলে তা
ফিস্টুলায় রূপ নিতে পারে।
অ্যাানাল ফিস্টুলার সাধারণ লক্ষণসমূহ
অ্যানাল ফিস্টুলা শরীরে নানা ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায়
লক্ষণগুলো হালকা হলেও সময়ের সঙ্গে তীব্র হতে পারে। অনেকেই পাইলস ভেবে ভুল করেন এবং চিকিৎসায় দেরি
করেন। নিচে অ্যানাল ফিস্টুলার সাধারণ ও লক্ষণীয় উপসর্গগুলো তুলে ধরা হলো।
মলদ্বারের পাশ দিয়ে পুঁজ বা রক্তপাত
দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা জ্বালা (বিশেষত মলত্যাগের সময়)
মলদ্বারের পাশে ফোলা বা লালচে ভাব
চামড়ার নিচে চুলকানি ও জ্বালা
মলত্যাগের পর অস্বস্তি ও অসম্পূর্ণ অনুভব
জ্বর ও দুর্বলতা (ইনফেকশনের কারণে)
ফিস্টুলা ও পাইলস-এর পার্থক্য
অনেকেই অ্যানাল ফিস্টুলা ও পাইলসকে এক মনে করেন, অথচ এ দুটি ভিন্ন রোগ। উপসর্গে কিছু মিল থাকলেও
রোগের কারণ, গঠন এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে রয়েছে স্পষ্ট পার্থক্য। ভুল ধারণা রোগের জটিলতা বাড়াতে পারে।
তাই নিচে সহজভাবে তুলে ধরা হলো ফিস্টুলা ও পাইলস-এর মূল পার্থক্য।
বিষয়
অ্যানাল ফিস্টুলা
পাইলস (Hemorrhoids)
অবস্থান
মলদ্বার ও বাইরের চামড়ার মাঝে টানেল
মলদ্বারের ভেতরে বা বাইরের রক্তনালী ফুলে ওঠে
লক্ষণ
পুঁজ/রক্তপাত, ব্যথা, ফোলা
রক্তপাত, চুলকানি, মলদ্বারের বাইরে গোটা
ব্যথা
অনেক সময় তীব্র ব্যথা হয়
সাধারণত ব্যথা কম। জটিল হলে তীব্র ব্যাথা হতে পারে।
চিকিৎসা
অস্ত্রোপচার প্রাধান্য
ওষুধ ও লাইফস্টাইলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
অ্যানাল ফিস্টুলার চিকিৎসা
অ্যানাল ফিস্টুলা সাধারণত ওষুধে পুরোপুরি ভালো হয় না। এক্ষেত্রে চিকিৎসার মূল উপায় হচ্ছে
অস্ত্রোপচার। তবে প্রথমে রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন করে চিকিৎসক চিকিৎসার ধরন ঠিক করেন। এখানে অ্যাানাল
ফিস্টুলার কতিপয় কার্যকারী চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ:
সেটন পদ্ধতি (Seton placement): একটি বিশেষ ধরনের সুতা ফিস্টুলার ভেতরে দিয়ে ধীরে ধীরে
ইনফেকশন পরিষ্কার করা হয়। জটিল
ফিস্টুলায় এটি ব্যবহৃত হয়।
ফিস্টুলোটমি (Fistulotomy) ও ফিস্টুলেকটমি (Fistulectomy): এটি সবচেয়ে সাধারণ
অস্ত্রোপচার পদ্ধতি। এতে পুরো ফিস্টুলা ট্র্যাকটি কেটে ফেলে দেওয়া হয়।
এডভান্সমেন্ট ফ্ল্যাপ (Advancement Flap): যাদের ইনকন্টিনেন্সের ঝুঁকি বেশি (যেমন:
বয়স্ক), তাদের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
লেজার চিকিৎসা (Laser Ablation / FiLAC / DLPL): এই আধুনিক পদ্ধতিতে কোনো কাটাছেঁড়া
ছাড়াই
লেজারের সাহায্যে ফিস্টুলা ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
লিফট পদ্ধতি (LIFT procedure): ফিস্টুলার ট্র্যাকটিকে লিগেট বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জটিল
এবং গভীর ফিস্টুলায় এটি
কার্যকর।
ফিস্টুলা অপারেশন পরবর্তী করণীয়
ফিস্টুলার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই আপারেশন করতে হয়। রোগীদের একটি সাধারণ জিজ্ঞাসা থাকে, অপারেশন এর
পরে রোগীর করণীয়, কীভাবে দ্রুত আরোগ্য পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি। এখানে আমরা রোগীর করণীয় সম্পর্কে
কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো:
নিয়মিত ড্রেসিং ও পরিষ্কার রাখা
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন
বেশি পানি পান করা ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া
দীর্ঘ সময় বসে থাকা এড়িয়ে চলা
মল স্বাভাবিক রাখা
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
যদি মলদ্বারের পাশে বারবার ফোঁড়া, পুঁজ বা রক্তপাত দেখা যায় কিংবা ব্যথা ও জ্বালাভাব দীর্ঘস্থায়ী
হয়, তবে এটি ফিস্টুলার লক্ষণ হতে পারে। এমন উপসর্গ দেখা দিলে তা অবহেলা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সময়মতো চিকিৎসা না করলে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে। কারণ, ফিস্টুলা
সাধারণত নিজে নিজে সারে না। কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন, এটা বোঝা খুব জরুরি, নিচে কয়েকটি গুরুতর কারণ
উল্লেখ করছি:
মলদ্বারের পাশে দীর্ঘদিন ব্যথা বা অস্বস্তি থাকলে
মলত্যাগের সময় রক্ত বা পুঁজ বের হলে
আগেও অ্যাবসেস বা ফোড়া হয়েছে এবং এখন নতুন ফোঁড়া দেখা দিচ্ছে
অপারেশনের পর ইনফেকশন বা ব্যথা বাড়ছে
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন এখনই!
অ্যানাল ফিস্টুলা একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা। লজ্জা না করে প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক
চিকিৎসা ও অভিজ্ঞ সার্জনের সহায়তা নিলে দ্রুত আরোগ্য লাভ সম্ভব। যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ এই
সমস্যায় ভুগে থাকেন, দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অ্যানাল ফিস্টুলা সাধারণত ওষুধ বা ঘরোয়া উপায়ে সম্পূর্ণভাবে সারে না। কারণ এটি শরীরের
ভেতরে একটি টানেল তৈরি করে, যা অপারেশন ছাড়া পুরোপুরি দূর করা যায় না। তবে কিছু
ক্ষেত্রে যদি ফিস্টুলা খুব ছোট হয় বা জটিল না হয়, তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পর্যবেক্ষণে
কিছু অস্থায়ী চিকিৎসা দিতে পারেন। তবুও স্থায়ী সমাধানের জন্য অস্ত্রোপচারই সবচেয়ে
কার্যকর উপায়।
খুব বিরল ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অ্যানাল ফিস্টুলা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে, তবে সাধারণত
ফিস্টুলা ক্যান্সারের কারণ নয়। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বা পুরনো ইনফেকশন যদি বছরের পর বছর
অবহেলিত থাকে, তখন ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই সময়মতো চিকিৎসা নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।
ফিস্টুলার মূল চিকিৎসা অস্ত্রোপচার হলেও কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি সাময়িক আরাম দিতে পারে,
যেমন গরম পানিতে সিটজ বাথ (বসে থাকা), আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান এবং মল
নরম রাখার ব্যবস্থা করা। তবে এগুলো কেবল উপসর্গ উপশমে সহায়ক—ফিস্টুলা নির্মূল করতে নয়।
ফিস্টুলা হলে এমন খাবার এড়ানো উচিত যা কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করে বা মলত্যাগে চাপ বাড়ায়।
যেমন: অতিরিক্ত ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার, ভাজাপোড়া, চর্বিযুক্ত খাবার এবং দুধজাত কিছু পণ্য।
পাশাপাশি ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকেও দূরে থাকা উচিত। বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার ও তরল
গ্রহণ ফিস্টুলা রোগীদের জন্য উপকারী।
Discover the key symptoms of anal fissures, including pain, bleeding, and itching. Learn when to seek medical help to prevent complications. Consult now!
Learn what causes itching and pain in the anus, common symptoms, and when it's time to see a doctor. Get expert tips for relief and treatment. Consult now!