পায়ুপথে চুলকানির কারণ ও চিকিৎসা
| ডা: তারিক আখতার খান
সামাজিক ভদ্রতার বিচারে পায়ুপথের চুলকানি বেশ বিব্রতকর। যারা এই
চুলকানির রোগে ভুগছেন, তারা প্রায়ই অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে পড়ে থাকেন।
লোক-লজ্জার ভয়ে কিংবা নানা কারনের এই রোগ নিয়ে মুখ খোলেন না অনেকেই, আর
সঠিক চিকিৎসা না নেওয়ার ফলে দিনদিন আরো পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। অথচ
পায়ুপথের নানা জটিলতার উপসর্গ হতে পারে এই চুলকানি। আপনি জেনে অবাক
হবেন যে, আমাদের দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২ থেকে ৫ শতাংশ লোকই এ
অস্বস্তিকর রোগের মনোকষ্টে ভুগছেন। আবার নারীদের তুলনায় পুরুষের
পায়ুপথে চুলকানির প্রবনতা থাকে বেশি। গঠনগত ভাবেই পায়ুপথ বেশ সংবেদনশীল
জায়গা, এ স্থানের সামান্য অনিয়ম আপনাকে দীর্ঘদিন ভোগাতে পারে। তবে সঠিক
সময় চিকিৎসা নিলে এবং নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন মেনে চললে সম্পূর্ণভাবে
মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক, পায়ুপথের চুলকানির
সঠিক কারণ ও এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে।
মলদ্বারে চুলকানির কারণ ও প্রতিকার/চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের জন্য পরামর্শ
দিয়েছেন বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক
ডা. তারিক আখতার খান।
পায়ুপথের চুলকানির পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারনের মধ্যে আমাদের
কিছু বদভ্যাস দায়ী। আমাদের অভ্যাসের সাথে জড়িত কিছু কারণ এখানে তুলে
ধরছি:
পরিচ্ছন্নতা: তাড়াহুড়ো ও অসচেতনতার কারণে আমরা অনেক সময় পায়ুপথ
সঠিকভাবে পরিস্কার করি না, যার কারণে ব্যাকটেরিয়া ও নানাবিধ এলার্জেন্ট
পদার্থ পায়ুপথে লেগে থাকে–যা পরবর্তীতে চুলকানির কারণ হতে পারে। আবার
অধিকাংশ সময় আমরা জানিই না পায়ুপথ কীভাবে পরিস্কার করতে হয়। পায়ুপথ
অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চল হওয়ায় এখানে শক্ত টিস্যু পেপার, ঘষে পরিস্কার
বা সাবান দিয়ে পরিস্কার করা সম্পূর্ণ নিষেধ, আলতো ভাবে নরম টিস্যু
ব্যবহার এবং পানি দিয়ে পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা জরুরি
পায়ুপথ অধিক পরিচ্ছন্নতা করার জন্য নানা রকম ক্যামিকেল ও সাবান ব্যবহার
হতে পারে চুলকানির আরেকটি কারণ।
মুসলিম বিশ্বে পরিষ্কারজনিত কারণে পায়ুপথের সমস্যা কম। মুসলিমরা যেহেতু
ধর্মীয় কারণেই পানি দিয়ে মলদ্বার পরিষ্কার করেন, তাই তাদের মলদ্বারের
ত্বক তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে।
খাবার: পায়ুপথের চুলকানির অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ডায়েট
প্ল্যান। দূর্ভোগ সৃষ্টিকারী যেসকল খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে, সেগুলো হলো: চা, কফি, মদ, বিয়ার, টমেটো, পনির, অধিক মসলাযুক্ত
খাবার, বাদাম ইত্যাদি। এছাড়া অনিয়মিত খাবার, আশ-যুক্ত খাবার কম খাওয়ার
কারনেও পায়ুপথ রুক্ষ হয়ে ইনফেকশন হতে পারে–যা এক সময়ের চুলকানির কারণ।
পায়ুপথের চুলকানির কারণ |
স্বাস্থ্যগত
পায়ুপথের চুলকানির পেছনে শুধু খাবার বা পরিচ্ছন্নতাই দায়ী নয়। এর পেছনে
রয়েছে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত নানা কারণ। এই অংশ আমরা তুলে ধরব
কোন কোন শারীরিক জটিলতার কারনেও হতে পারে পায়ুপথের চুলকানি:
পায়ুপথের মাংসপেশীর দুর্বলতা: পায়ুপথের মাংপেশীর দূর্বলতা
পায়ুপথের চুলকানির আরেকটি বিশেষ কারণ। সাধারণত চল্লিশের পর অনেকেরই
মলদ্বারের মাংসপিণ্ড কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। এতে পায়খানা তরল বা একটু
নরম হলে নিজের অজান্তেই মলরস ছুঁয়ে মলদ্বার অপরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফলে
পায়ুপথের নানা রকম সংক্রমণের কারণে চুলকানি হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে
এ সমস্যা আমাদের তুলনায় বেশি।
ত্বকের নানা রোগ: অনেক সময় ছত্রাকজনিত ও নানা রকম জীবানু
পায়ুপথের আশেপাশের ত্বকে অবস্থান করে। যা চুলকানি বৃদ্ধিতে সহায়ক
ভূমিকা পালন করে। কিছু সাধারণ রোগ যেমন-
একজিমা, সরিয়াসিস ইত্যাদি মলদ্বার এ চুলকানির কারণ হয়ে থাকে।
পায়ুপথের একটি খুব সাধারণ সংক্রমণ হচ্ছে ক্যান্ডিডিয়াসিস ও
অন্যান্য ফাঙ্গাস সংক্রমণ। ডায়াবেটিস ও অন্যান্য যেসব রোগে শরীরের
প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়, সেখানে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। অনেক
সময় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা
যায়। এ রোগে চুলকানি অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়।
কৃমি: বিশ্বের জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত থাকে
পিন ওয়ার্ম বা সুতা কৃমিতে। সুতা কৃমি সব সময় অক্সিজেনের জন্য
মলদ্বারের আশেপাশে অবস্থান নেয়, যা মলদ্বারের চুলকানির অন্যতম কারণ।
শারীরিক অন্যান্য রোগ: আমাদের শরীরের নানা রকম রোগ যেমন:
পাইলস, এনাল ফিসার, কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়ায় মলদ্বারে চুলকানি হতে
পারে; এছাড়াও কিছু শারীরিক রোগের কারণে পায়ুপথে তীব্র চুলকানি হয়,
যেমন পায়ুপথের ক্যান্সার, রক্তের ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার,
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ ইত্যাদি।
পায়ুপথের চুলকানি থেকে মুক্তির
ঘরোয়া টিপস
পায়ুপথের চুলকানি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই; একটু সচেতন
হলেই অধিকাংশ চুলকানির জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত ঘরে বসে
যেসব নিয়ম মেনে চুলকানি থেকে রেহাই পেতে পারেন। যেমন-
অ্যালার্জি হয় এমন খাদ্য এড়িয়ে চলা।
মলত্যাগ ও অতিরিক্ত ঘামের পর মলদ্বার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার ও শুষ্ক
রাখা।
সুতি কাপড়ের ঢিলাঢালা অন্তর্বাস ব্যবহার করা।
রঙিন, সুগন্ধিযুক্ত ও খসখসে টয়লেট পেপার ব্যবহার না করা।
সুগন্ধি সাবান ব্যবহার না করা।
যখন নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ
স্বাভাবিকভাব ঘরোয়া চিকিৎসা বেশ কার্যকারী, তবে চুলকানির মাত্রা এবং
স্থায়ীত্ব বেশি হলে বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের
পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কোন উপসর্গগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন
হবেন, তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
তীব্র ও সবসময় চুলকানি হওয়া।
যদি চুলকানির সঙ্গে রক্ত যায়।
সংক্রমণ (ইনফেকশন) ঘটলে।
মলদ্বারে চাকা থাকলে।
পায়ুপথের চুলকানির ঔষধ ও চিকিৎসা
পায়ুপথের চুলকানির সঠিক চিকিৎসার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসকের এবং সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার। নিচে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো:
পরীক্ষা-নিরীক্ষা: কোলন ও রেক্টাম বা মলাশয়ে প্রদাহ হয়ে
এমনটি হতে পারে। তাই মলদ্বারের ভেতরে কোলনস্কপি পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
প্রয়োজনে ত্বকের হিসটোপ্যাথলজি ও ছত্রাক (ফাংগাস) পরীক্ষা করা যেতে
পারে।
চিকিৎসা: বিভিন্ন ধরনের পথ্য, পেটেন্ট ওষুধ ও লোশন ব্যবহারে
কমবেশি উপকার পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনও ব্যবহার করা হয়।
কোনো কোনো সার্জন মলদ্বারের ত্বক কেটে ফেলে নতুন ত্বক লাগিয়েও সমস্যা
সমাধানের চেষ্টা করেছেন।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে
যোগাযোগ করুন
পায়ুপথের চুলকানি একটি বিব্রতকর ও জটিল সমস্যা। তার জন্য প্রয়োজন
সচেতনতা ও সুচিকিৎসার। অল্প থাকতে অবহেলা না করে অভিজ্ঞ পায়ুপথ
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তারিক আখতার খান
বাংলাদেশের একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ চিকিৎসক। পরামর্শ বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর
জন্য যোগাযোগ করুন এখনই।
যদি চুলকানি দীর্ঘদিন ধরে থাকে বা সাথে রক্তপাত, ব্যথা বা ফোলা
দেখা যায়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এটি পাইলস,
ফিশার বা অন্য কোনো জটিল রোগের লক্ষণ হতে পারে।
পায়ুপথে চুলকানি প্রতিরোধে করণীয়:
মলত্যাগের পর ভালোভাবে পরিষ্কার করা।
টাইট ও সিন্থেটিক কাপড় পরিহার করা।
মশলাদার খাবার এড়ানো।
নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা।
হ্যাঁ, যদি সমস্যাটি গুরুতর না হয় তবে ঘরোয়া চিকিৎসা এবং
জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে চুলকানি উপশম করা সম্ভব। তবে
দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ক্রিম,
অ্যান্টি-হিস্টামিন ট্যাবলেট বা হাইড্রোকর্টিসন ক্রিম ব্যবহার
করা যেতে পারে। তবে নিজে থেকে ওষুধ ব্যবহার না করাই ভালো।
ডাক্তারের নিকট পরামর্শ নিয়ে ব্যাবহার করতে হবে।